"এই তোমরা খেয়ে যাবে কিন্তু
না খেয়ে গেলে মাইর দিবো"
না খেয়ে গেলে মাইর দিবো"
কথাগুলো বলছিলেন একজন মা "রমা চৌধুরী"। উনার অসুস্থতার কথা শুনে মানবিক বন্ধু সুজন আর অনিককে সঙ্গে নিয়ে আমরা গিয়েছিলাম উনাকে একনজর দেখতে। তিনি চট্টগ্রাম ডায়বেটিকস হাঁসপাতালে গত ১১ই ডিসেম্বর থেকে ভর্তি আছেন ডায়বেটিকস, পাকস্থলীতে পাথর সহ নানা শারীরিক সমস্যা নিয়ে।
বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী যার জন্ম ১৯৪১ সালে বোয়ালখালী পোপাদিয়া গ্রামে। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। বলা হয়ে থাকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর এই রমা চৌধুরী।
আমরা অনেকে রমা চৌধুরী সম্পর্কে পড়েছি, শুনেছি আবার অনেকে নাও জেনে থাকতে পারি, কিন্তু কয়জনে এই কিংবদন্তীর সরাসরি সাক্ষাৎ পেয়েছেন? হাতে গোনা খুব অল্প সংখ্যাক মানুষের সৌভাগ্য হয়েছে তার সাক্ষাৎ পাওয়ার তার মধ্যে আমি একজন পরম সৌভাগ্যবান যার সান্নিধ্য পেয়েছি, স্পর্শ পেয়েছি, আবেগমাখা বকুনি খেয়েছি, আশীর্বাদ পেয়েছি! আমরা যেহেতু উনার পূর্ব-পরিচিত ছিলাম না তাই তার কেবিনে প্রবেশ করতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন কোথা থেকে এসেছো, আমি কোন সাক্ষাৎকার দিতে পারবোনা বলে বিরক্তি প্রকাশ করলেন। জবাবে মানবিক বন্ধু অনিক জানালো "মা আমরা আপনার সন্তান কোন সাক্ষাৎকার নিতে আসিনি, আমরা এসেছি আপনাকে দেখতে আপনার সাথে গল্প করতে"। সাথে সাথেই তিনি শান্ত হলেন এবং কোন আঞ্চলিকতার টান ছাড়াই শুদ্ধ উচ্চারণে বললেন "বোসো তোমরা খেয়ে যাবে কিন্তু না খেয়ে যাবে না" (যদিও শুদ্ধ উচ্চারণের ব্যাপাটা তখনি খেয়াল করলাম)।
সন্তান হারানোর পরে তিনি কোনদিন স্যান্ডেল কিংবা কোন প্রকার জুতা পায়ে দেননি এই অসীম সাহসী মহীয়সী।
-এমন ঠাণ্ডায় উনি খালি পায়ে আছেন কেন?
এমন প্রশ্ন করেই নিজের স্মৃতি শক্তিকে ভৎসনা করে জিভে কামড় দিলাম। তারপর এক এক করে শুনছিলাম তার সব অসীম সাহসের বর্ণনা কখোন রমা চৌধুরীর নিজের মুখে কখোন সহকারীর মুখে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রমা চৌধুরীর স্বামী যখন ভারতে চলে যান তখন তিনি একা তিন সন্তান ও বৃদ্ধা মা কে সাথে নিয়ে দীর্ঘ আট মাস বোয়ালখালীর জঙ্গলে পালিয়ে থাকতেন। সারা দিন জঙ্গলে ঘুরা-ফেরা করলেও রাতে তার পোড়া ভিটায় এসে প্লাস্টিক কিংবা খড়কুটো আচ্ছাদিত করে রাত্রি যাপন করতেন, তবুও দেশ ত্যাগের কথা কিংবা বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে নিজের আত্ন-হনন এর কথা একবারও চিন্তা করেননি। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়েও এই অসীম সাহসী মহীয়সী তার বাসা ছেড়ে কোথাও যাননি শুধু বলেছেন "দেখি না কি হয়"।
রমা চৌধুরী অন্যকারো দয়া-দাক্ষিণ্য ছাড়াই নিজের সংগ্রামী জীবনের গল্প রচনা করে চলেছেন এখনো পর্যন্ত। নিজের লেখা ১৮ টা বই প্রকাশ করেছেন আর সেই বই খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করেই দিনযাপন করেন এই কিংবদন্তি। তারপরও তার চোখে-মুখে বিজয়ের হাসি।
রমা চৌধুরীর খুব ইচ্ছা বাংলা লোক-সাহিত্য ও সংস্কৃতি রক্ষায় কিছু একটা করা, একটা সংগ্রহশালা গড়ে তোলা যেখানে থাকবে বাংলার সকল অঞ্চলের আঞ্চলিক ইতিহাস, ঐতিহ্য, নিদর্শন ও ভাষা সমূহের দলিলাদি, আর সেখানে তরুণ প্রজন্ম গবেষণা করে তাকে করে তুলবে আরো সমৃদ্ধ রূপে। মাঝে মাঝে কিছুটা হেসে কিছুটা কাঁদো কাঁদো গলায় কথাগুলো বলছিলেন আর বলছিলেন "এই তোমরা খেয়ে যাবে কিন্তু, না খেয়ে গেলে মাইর দিবো"।
অদম্য এক ইচ্ছাশক্তি রমা চৌধুরীকে আজো প্রাণচঞ্চল করে রেখেছে। আজন্ম লালিত স্বপ্ন মানুষের জন্যে কিছু করার তাগিদ তাকে আজো অনুপ্রেরণা দেয় বলে আমার বিশ্বাস তা না হলে কিভাবে একটা মানুষ এত ঝড় এত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে হাসিমুখে বলতে পারে "আমি আরো বেঁচে থাকতে চাই আমার তো এখনো কিছুই করা হয়নি"।
ধন্যবাদ সুজন চৌধুরী ও অনিক ইসলাম!
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন